দলীয় নেতা-কর্মীদের সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রতিহিংসাপরায়ণ হবেন না। শুক্রবার দলীয় কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের কল্যাণে কাজ করার আহ্বানও জানান তিনি।
‘সংগ্রাম ও সাফল্যের ৬০ বছর’ স্লে¬াগান আর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সকাল সাড়ে ১০টায় দিনব্যাপী এ কাউন্সিল শুরু হয়েছে।
কাউন্সিলের উদ্বোধনী ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রয়াত চার নেতা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণ করেন হাসিনা। তিনি স্মরণ করেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস তুলে ধরে হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যই আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এদেশের সব অর্জনেই রয়েছে আওয়ামী লীগের অবদান।
তিনি বলেন, “বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় চেষ্টা ছিল, কীভাবে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা যায়। কিন্তু অগণিত নেতা-কর্মীর সক্রিয়তায় সে অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
“আমি যখন বন্দি ছিলাম, চেষ্টা করা হয়েছে রাজনীতি থেকে আমাকে বিদায় দেওয়ার। নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছে। বিদেশে থাকা অবস্থায় আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ওয়ারেন্ট জারি করা হলো। আমাকে দেশে ফিরতে বাধা দেওয়া হলো। বলা হলো, বিমানবন্দরে নামলে গুলি করা হবে। কিন্তু আমি বলেছিলাম, মরলে দেশের মাটিতেই মরব।”
“আমি দেশের মাটিতে ফিরে ছিলাম। এ জন্য অগণিত কর্মী ও আর প্রবাসীদের সমর্থন ছিল। বিদেশি বন্ধুরাও সমর্থন দিয়েছিলেন।”
তিনি বলেন, “আমি কারও কাছে মাথা নত করিনি, করবও না। বাংলার মানুষের জন্য সংগ্রাম করে যাব। একটাই চাইব, তা হলো বাংলার মানুষের ভালবাসা।”
দেশকে এগিয়ে নিতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সক্রিয় হওয়ার তাগিদ দিয়ে হাসিনা বলেন, “বাংলার মানুষের কল্যাণই হবে আওয়ামী লীগের একমাত্র লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে আপনাদের কাজ করতে হবে।”
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দলীয় কর্মীদের তৎপরতার প্রশংসা করে তিনি বলেন, আপনারা সব সময় মাঠে ছিলেন। ভয়-ভীতি-প্রলোভনে কেউ কেউ পরাভূত হয়েছে। নানা ধরনের নির্যাতন হয়েছে, যা সহ্য করার দৃঢ়তাও কারও কারও ছিল না।
আওয়ামী লীগ প্রধান দলের আগামী নেতৃত্বকে প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার আহ্বান জানান।
নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমরা সরকারে আছি। তাই সবাইকে সহনশীল হতে হবে। প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ নয়।”
সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরে হাসিনা বলেন, “আমাদের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল ক্ষমতায় গেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি কমানো, তা কমিয়েছি। বর্তমানে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
“আমরা সার এবং ডিজেলের মূল্যও কমিয়েছে। বৃষ্টি না হওয়ায় খাদ্য উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় সেজন্য সেচের ব্যবস্থা করছি। সীমিত আয়ের মানুষের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করেছি। এ সরকারের আমলে কেউ না খেয়ে কষ্ট পাবে এটা হতে পারেনা, হতে দেব না।”
হাসিনা বলেন, “প্রতিটি পরিবারের একজন কর্মক্ষম যুবক যাতে কাজ পায় সে কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। এছাড়া যুবক ও যুব মহিলাদের কর্মক্ষমতা বাড়াতে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছি। পথশিশুদের কর্মক্ষম হিসেবে গড়ে তোলার কর্মসূচি নিয়েছি। গত সাত মাসে দেশ ও জাতির কল্যাণে অনেক কর্মসূচি হাতে নিয়েছি, যার লক্ষ্য হলো এ দেশ ও এ জাতি যাতে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারে।”
জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে শুরু হয় কাউন্সিল। জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এর পরপরই শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে সম্মেলন উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ওই সময় ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ ¯ে¬াগানে মুখর করে তোলে অনুষ্ঠানস্থল।
অর্ধ শতাব্দি প্রাচীন এ দলটির কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সারাদেশ থেকে প্রতিনিধি-পর্যবেক্ষকরা ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও কূটনীতিকরা যোগ দিয়েছেন।
সম্মেলন কেন্দ্রের মূল ভবনের ঠিক সামনে মঞ্চ করা হয়েছে। সেখানে বসেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। মঞ্চের সামনে তৈরি করা প্যান্ডেলে আসন নিয়েছেন অতিথি এবং দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
সভা মঞ্চে শেখ হাসিনা যেখানে বসেন তা বুলেট প্র”ফ কাচে ঘেরা। একই ধরনের নিরাপত্তা ছিল তার বক্তৃতার ডায়াসেও।
মঞ্চের পেছনে ব্যানারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তাজউদ্দিন আহমেদসহ প্রয়াত নেতাদের ছবি রয়েছে। সকাল থেকেই মাইকে শোনানো হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই কুরআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠ করা হয়। এরপর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন দলের দপ্তর সম্পাদক আব্দুল মান্নান খান। এরপর স্বাগত ভাষণ দেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন প্রচার সম্পাদক আসাদুজ্জামান নূর।
অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন অজিত রায়ের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা।
কেন্দ্রীয় নেতা ফজলুল হক মিলন, সাবেক সাংসদ শিরীন সুলতানা ও শিমুল বিশ্বাস সমন্বয়ে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগ দিয়েছে। অন্য দলের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মনজুরুল আহসান খান, সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়–য়া, গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ আফজাল প্রমুখ।
আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ঘিরে সম্মেলন কেন্দ্র ও আশপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর দুপুরে কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়।
গণপ্রতিনিধিত্ব আইন মেনে নির্ধারিত সময় ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে কাউন্সিল করে গঠনতন্ত্র জমা দেওয়ার লক্ষ্যে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলটি স্বল্প সময়ের নোটিশে এ কাউন্সিল করছে।
এটি আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিল। এর আগের কাউন্সিল হয়েছিল ২০০২ সালে।
গঠনতন্ত্র অনুমোদনের বাইরেও কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে।
সভাপতি পদে আবারও শেখ হাসিনার থাকার বিষয়টি কার্যত নিশ্চিত হলেও সাধারণ সম্পাদকের পদটি নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
দলীয় কাউন্সিলের তিন দিন আগে উপেক্ষার ‘ক্ষোভ থেকে’ পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে।
দলের দপ্তর সম্পাদক আব্দুল মান্নান খান জানান, এবার কাউন্সিলরের সংখ্যা ৫ হাজার ২৫৩ জন। নিয়ম অনুযায়ী কাউন্সিলররাই নির্বাচন করবেন দলের পরবর্তী নেতৃত্ব।
কাউন্সিলের সফলতা কামনা করে ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশ পথসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে।
সম্মেলনকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের বিদায়ী কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় জন্ম নেয় আজকের আওয়ামী লীগ। বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথে নেতৃত্ব দিয়েছে এ দল।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের প্রথম সরকার ছিল আওয়ামী লীগের। ১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত পটপরিবর্তনের দীর্ঘ দিন পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় ফেরে দলটি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় এলে হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।